শনিবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২২

Koda Adivasi

ভারত বর্ষের  আদিবাসী সম্প্রদায়রা আজ থেকে প্রায় ৬৫ হাজার বৎসর আগে, আফ্রিকা থেকে নরগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ ধীরে ধীরে অন্যান্য মহাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই দলটি প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন। এদের গায়ের রং কালো, নাক অনুচ্চ, চুল কালো ও কুঞ্চিত, উচ্চতা মাঝারি। এই ভাষা গোষ্টির মানুষরা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের এর অন্তরর্গত, এই জনজাতি ভাষা গোষ্ঠী গুলি হল যথাক্রমে :-

আসুরি (Asuri)।

বিরহোর (Birhor)।

হো (Ho)।

কোডা (Koda)।

কোল (Kol)।

কোর্‌ওয়া (Korwa)।

মুণ্ডা (Munda)।

মুণ্ডারি (Mundari)।

সাঁওতালি (Santali) 

মাহালি (Mahali)।

তুরি (Turi)। প্রভৃতি।

এছাড়াও কোড়া(কোডা) ভাষাটি মুন্ডাদের একটি বিছিন্ন শাখা । সাধারণভাবে এদের ভাষাকে অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আজ আদিবাসী কোড়া(কোডা) সম্প্রদায়ের ভাষা বিলুপ্তের পথে এসে দাড়িছে, এই আদিবাসী কোড়া(কোডা) সম্প্রদায় নিজেদের ছোটনাগপুরে বর্তমানে ঝাড়খন্ড রাজ্যের আদিম জনজাতি বা নিজেদের জন্মস্থান(জানাম দিশুম) বলে থাকে। এক সময় এই কোড়া জনজাতি তাদের কাজের তাগিতে এবং ইংরেজ আমলে এই জনজাতির মানুষজন দিয়ে বিভিন্ন রকম জলাশয়, পুকুর, দিঘী ও রেল লাইন নির্মানে কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল, তাই এই কাজের সূত্রে তারা ভারত বর্ষে বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন:- ১) বিহার, ২) ঝাড়খন্ড, ৩)পশ্চিমবঙ্গ, ৪) ঊড়িষ্যা, ৫)আসাম, প্রভৃতি, এছাড়াও আমাদের দেশের প্রতিবেশীদেশ ১) বাংলাদেশ  ও ২) নেপালে কোড়াদের দেখতে পাওয়া যায় তা হল খুব অল্প সংখ্যাক।

আদিবাসী কোড়া(KORA)জাতির জনসংখ্যা ২০১১ আদমসুমারি অনুসারে পুরুষ ও মহিলা:-

১) পশ্চিমবঙ্গ:- ১,৫৯,৪০৪ জন,

২) উড়িষ্যা:- ৫৪,৪০৮ জন,

৩) ঝাড়খন্ড:- ৩২,৭৮৫ জন,

৪) বিহার:- ১৬,৫৮০ জন,

এই চারটি রাজ্যে কোড়াদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২,৬৩,১৭৮ জন।

এছাড়া ও আসামে কোড়া জনজাতি টি-ট্রাইব নামে পরিচিত।

প্রাক আর্য যুগে অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৫০০০ বছর থেকে ৩০০০ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষে যে অষ্ট্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই অষ্ট্রিকজন গোষ্ঠীর মানুষ হল সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, হো, কোড়া(কোডা) প্রভৃতি। কালের স্রোতে উৎথান, পতন, জয় পরাজয়, বাধা বিপত্তি নানা বিপর্যয়ের মধ্যে এসব গোষ্ঠীর মানুষ এখনও টিকে আছে। তাদের নিজেদের বহু আচার অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক জীবনের নানা উপদান,নানা বিষয় আজ অবলুপ্ত,  তথাপি এই সব জনগোষ্ঠীর খীর্নধারা এখন ও প্রবাহমান।  এদের মধ্যে কোড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠী জীবন সংগ্রাম করে নিজের সত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজও। 

অস্ট্রিক ভাষাভাষী মানুষদের একটি বড় অংশ ভারতবর্ষের প্রবেশ করেছিল খাইবার বোলান গিরিপথ দিয়ে, গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডাস-এর বিবরণ থেকে তা  জানা যায়।

ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থ্যাৎ ১৯৫৬ সালে কোড়া(কোডা) সম্প্রদায়কে আদি উপজাতি হিসাবে 'সিডিউল্ড ট্রাইব' রুপে স্বীকৃতি পাই, কিন্তুু এই কোড়া(কোডা) জাতি অনেক আদি পূর্ব থেকে বংশ পরম্পরায়  ভারতবর্ষের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের ছোটনাগপুরে বসবাস করে আসছে। তাই কোড়া(কোডা) আদিবাসীরা ছোটনাগ পুরের আদিবাসী, তারা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে মুঙ্গে, ভগল পুর, হাজারীবাগ, ধলভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে, আদিবাসী কোড়ারা বিভিন্ন গোষ্টিতে বিভক্ত ছিল... যেমন ধলো, মালো, শিখরিয়া, সোনারেখা, বাদামিয়া, প্রভৃতি পাওয়া যায় ধীরেনন্দ্রনাথ বাস্কের লেখা  "পশ্চিম বঙ্গের আদিবাসী সমাজ" বই থেকে।

এছাড়,ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক H. H. Risle সাহেব কোড়াদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে " The Tribes & Castes of Bengal" গ্রন্থে বলেছেন...যারা ধল অঞ্চলে এসেছিলেন তারা ধলো, যাহারা মানভূম থেকে এসেছিলেন তাহারা মালো, যাহারা শিকার অঞ্চল থেকে এসেছিলেন তাহারা শিখারিয়া, আবার যাহারা সুর্বনরেখা নদী পাশের অঞ্চল থেকে এসেছিলেন তাহারা সোনারেখা নামে পরিচিত।

আর্যদের ভারতবর্ষে প্রবেশের পর বিভিন্ন অনার্যগোষ্ঠীর ভিতরে বিবাহাদি হতে থাকে। এই সময় আর্যদের আধিপত্য স্বীকার না করায়, অনেক স্থলে অনার্যদের সাথে আর্যদের সংঘর্ষ হয়। আর্যরা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হওয়ায়, অনার্যদের অনেকে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। দীর্ঘদিন ধরে নগর সভ্যতার সাথে সম্পর্কীহীন থাকায় এরা অরণ্যচারী আদিবাসীতে পরিণত হয়। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা দখল নেওয়ার পর, স্থানীয় জমিদার এবং পুলিশ প্রশাসনকে কর ও উৎকোচ প্রদানের ভার, ইউরোপীয় নীল-ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের নানাবিধ অত্যাচারে কোড়াদের জনজীবনকে দুর্বিসহ হয়ে উঠে। এই শোষন ও অত্যাচারে তাগিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত আদিবাসীদের বিদ্রোহ দেখা দেয় সেই সময়। এই কোড়া আদিবাসী সম্প্রদায় "কোড়া" কথার অক্ষরিক অর্থ মাটি "খোঁড়া"। আর এই আদিবাসীর এমন নামকরণ হওয়ার কারনে... এই সম্প্রদায় ঐ সময় বিভিন্ন জলাশয়,খাল, পুকুর, ও দিঘি খনন কার্যের মাটি কাটা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল কোড়া আদিবাসী সম্প্রদায়। এই জন্য কোড়া আদিবাসী প্রধান জাতি গত পেশা ছিল"মাটি কাটা"

ইংরেজ আমলে সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এই আদিবাসীরাই। ঐতিহাসিক H.H.Risle সাহেব কোড়াদের সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে গিয়ে " The Tribes & Castes of Bengal" গ্রন্থে বলেছেন -"Kora, Kaora, Khaira, Khayra a Dravidian Caste of earth workers and cultivators in Chhota Nagpur, Western and Central Bengal. Probly an offshoot from the munda Tribe"

 ইংরেজ আমলে মূলত রেল লাইনের কাজের সূত্র ধরেই ভারতের ঝাড়খন্ডে ছোটনাগ পুর থেকে এদের আগমন ঘটে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে..যেমন পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, আসাম, ভারত বর্ষের বাহিরে বাংলাদেশ ও নেপালে এই আদিবাসী কোড়া(কোড়া) জনগোষ্টির বিভিন্ন জায়গাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে বর্তমান সময়ে এই কোড়া সম্প্রদায়রা।

ঐতিহাসিক গিবার্সন তাঁর 'Linguistic survey of India' গ্রন্থে লিখেছেন সাঁওতাল, মুণ্ডারি, ভূমিজ, কোড়া, হো টুরি, আসুরি এবং কোরওয়া একই ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এই সব আদিবাসীদের সকলকে এক সময়ে "খেরওয়ার বা থারওয়া' বলা হতো। 

ভারত বর্ষের সবচেয়ে বেশি সংখ্যাক আদিবাসী কোড়ারা বসবাস করেন তা হল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে, এই রাজ্যের মোট  ২৩টি জেলা আছে, এই জেলা গুলিতে কমবেশি কোড়া মানুষদের বাসবাস দেখা যায়, তবে সবচেয়ে এই কোড়া জনজাতির বেশি সংখ্যাক মানুষরা বসবাস করেন তা হল যথা ১) পুরুলিয়া, ২) বাঁকুড়া, ৩) অবিভক্ত বর্ধমান, ৪) অবিভক্ত মেদিনীপুর(ঝাড়গ্রাম), ৫) বীরভূম, প্রভৃতি। সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে এই কোড়া জনজাতি তাদের জাতি সত্বার অতিত্ব সামাজি রীতি নীতি ধর্মীও পূজো পারবন  বজায় রেখেছে আজও, তাই এই জনজাতির আমাদের সবার কাছে কোড়া(কোডা) আদিবাসী নামে পরিচিত, এই কোড়া জাতির মাতৃ ভাষাকে "কোডা জাগার বা মাই জাগার বা কোড়া ভাষা" নামে পরিচিত আদিবাসী কোড়া সমাজে। আজ এই কোড়া ভাষা বিলুপ্তির পথে, কেন না..যারা শিক্ষিত কোড়া সমাজের মানুষরা নিজের ছেলে মেয়েদের ঐ কোড়া ভাষা শেখাতে চাই না, তাদের ধারনা মনে কোড়া ভাষা শেখার ফলে তাদের ছেলে মেয়েরা বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি শিখতে ও পড়তে অসুবিধে হচ্ছে, তাই হয়তো বর্তমান সময়ে কেউ এই কোড়া ভাষায় ছেলে মেয়েদের ঐ ভাষা শেখাতে চাইছেনা, তবে যারা এই কোড়া ভাষা শেখতে চাইছেন তার সংখ্যা খুব কম, এছাড়াও কিছু মানুষ আছেন যারা জনসম্মুখে এই কোড়া ভাষায় কথা বলতে লজ্জা বোধ করেন, কেননা..সকল মানুষ এই ভাষা না বোঝার জন্য নিজেদের বোকা বোকা মনে করে থাকেন, তাই এই ভাবে সভ্যতার বুক থেকে কোড়া ভাষা লুপ্ত হতে চলেছে, তাই সময় থাকতে কোড়া সমাজের বিভিন্ন সংগঠন বা কোন সেচ্ছাসেবী বা কোন সরকারী সংস্থ্যা এগিয়ে না আসে তাহলে একদিন সত্যকারে.. এই আদিম কোড়া ভাষা মানব সভ্যতার বুকে চিরতরে বিলুপ্তি ঘটবে। বর্তমান সময়ের শিক্ষিত যুব-যুবতীরা এই কোড়া ভাষায় কথা বলতে ভালো বাসেন কিন্তুু এর সংখ্যা খুব কম, তাই আমাদের প্রচেষ্টা ও চেষ্টা সময় থাকতে এই কোড়া মাতৃ ভাষাকে পুস্তক বা বই আকারে যাহাতে কোড়া ভাষা শেখান যায় তার জন্য কোড়া শব্দাংশ, বাক্যগঠন,  ব্যাকরন সহকারে ভাষা শেখার একটা সহজ পদ্ধতি বের করেছি আমরা । যারা মাধ্যমে অন্যান্য মানুষজনদের কোড়া ভাষা কে শিখতে ও বলতে পারে। কিন্তুু এর আগে এই ভাবে কোড়া ভাষার শেখার বই পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে পাওয়া যাবে না। সভ্যতার সাথে সাথে কোড়া সম্প্রদায়ের  মানুষের জীবন জীবিকা ও বদলেছে, এই কোড়া সমাজে শিক্ষার হার অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় অনেক কম, তবে যারা শিক্ষিত হয়ে আজ কেউ নিজের যোগ্যতায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, এই সম্প্রদায়ের শিক্ষার হার কম থাকার জন্য  তারা সমাজিক ও সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন ও শিক্ষা নিতে নিয়ে বাধা পাচ্ছে, বর্তমান সরকারে উচিৎ এই কোড়া সম্প্রদায়কে সার্বিক উন্নয়নের জন্য লধা-সবরের মতো  আলাদা ভাবে কোড়া উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে, এই বিলুপ্ত হতে যাওয়া কোড়া জাতির ভাষা, সামাজিক, এবং শিক্ষা ও সমাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার উভয়কে, তবেই এই কোড়া জাতিকে সভ্যতার বুক থেকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন